পদার্থের গঠন
আমাদের এ পৃথিবীতে কত অজস্র কত বিচিত্র বস্তু রয়েছে। কিন্তু আসলে এ বৈচিত্র্যময় বস্তুরাশি মাত্র কয়েকটি মূল পদার্থ দ্বারা গঠিত। প্রাচীনকালে গ্রীক ও ভারতীয় বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল যে, পানি, বায়ু এবং মাটি এ তিনটি মূল পদার্থ দ্বারা পৃথিবীর সমস্ত বস্তুরাশি গঠিত। ভারতীয় দার্শনিকরা আগুন এবং আকাশকেও মূল পদার্থ বলে মনে করতেন। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে আগুন বা আকাশ কোনটিই পদার্থ নয়, আবার পানি, বায়ু, মাটিও কোনো মূল পদার্থ নয়। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ক্যাভেনডিস প্রমাণ করেন যে পানি কোনো মূল পদার্থ নয়, পানি অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন নামক দুইটি গ্যাসীয় মৌলিক পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত।
তোমরা পূর্বেই পদার্থের কঠিন, তরল ও বায়বীয় অবস্থার কথা জেনেছ। পদার্থ যে অবস্থায়ই অবস্থান করুক না কেন গঠন অনুসারে বিজ্ঞানীরা পদার্থকে দুইটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন যথা- মৌলিক পদার্থ ও যৌগিক পদার্থ। মৌলিক ও যৌগিক পদার্থ কাকে বলে সে সম্পর্কে তোমরা পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণীতে প্রাথমিক ধারণা লাভ করেছ। এ অধ্যায়ে এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে ।
মৌলিক পদার্থ
যে পদার্থকে রাসায়নিক উপায়ে বিশ্লেষণ করলে ঐ পদার্থ ছাড়া পৃথক ধর্ম বিশিষ্ট অন্য কোনো নতুন পদার্থ পাওয়া যায় না তাকে মৌলিক পদার্থ বা মৌল বলে। হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন, গন্ধক, তামা, দস্তা, পারদ, সোনা, রুপা প্রভৃতি মৌলিক পদার্থ। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত মোট মৌলিক পদার্থের সংখ্যা ১১৮ টি । এর মধ্যে প্রকৃতিতে পাওয়া যায় ৯৮টি, অবশিষ্ট মৌলগুলো বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।
স্বাভাবিক অবস্থায় অধিকাংশ মৌলিক পদার্থ কঠিন, ৫ টি তরল এবং ১১টি গ্যাসীয়। লোহা, তামা, দস্তা, সোনা, রুপা, গন্ধক, অ্যালুমিনিয়াম, টিন, কার্বন, ফসফরাস, সিলিকন ইত্যাদি কঠিন মৌল ।
পারদ, ব্রোমিন, গ্যালিয়াম, সিজিয়াম, ও ফ্রান্সিয়াম তরল মৌল আবার হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ক্লোরিন, ফ্লোরিন, হিলিয়াম, নিয়ন, আর্গন, ক্রিপটন, জেনন ও রেডন হল গ্যাসীয় মৌল ।
যৌগিক পদার্থ
যে পদার্থকে বিশ্লেষণ করলে দুই বা ততোধিক সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্ম বিশিষ্ট মৌলিক পদার্থ পাওয়া যায় তাকে যৌগিক পদার্থ বলে। অন্য কথায় ভিন্ন ধর্ম বিশিষ্ট দুই বা ততোধিক মৌলিক পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত পদার্থকে যৌগিক পদার্থ বলা হয়। পানি, চিনি, সাবান, সোডা, লবণ, কার্বন ডাইঅক্সাইড ইত্যাদি যৌগিক পদার্থের উদাহরণ। মৌলিক পদার্থের সংখ্যা সীমিত হলেও যৌগিক পদার্থের সংখ্যার সীমা নেই। প্রতিদিন নতুন নতুন যৌগ তৈরি হচ্ছে। ফলে যৌগিক পদার্থের সংখ্যা দ্রুত বেড়েই চলেছে।
অণু ও পরমাণু, মৌলিক ও যৌগিক পদার্থের গঠন
প্রাচীনকালে ভারতীয় দার্শনিক কণাদ এবং গ্রীক দার্শনিক ডেমোক্রিটাসের মনে প্রশ্ন জাগে এ পৃথিবীর অসংখ্য পদার্থ কীভাবে গঠিত? তারা বলেন, কোনো একটি পদার্থকে যদি বারবার খণ্ড খণ্ড করা যায় তাহলে এমন এক অবস্থায় আসে যে সেই ক্ষুদ্রতম পদার্থ খণ্ডকে আর পণ্ড করা যায় না। কণাদ এ ক্ষুদ্রতম পদার্থ কণার নাম দেন পমাণু এবং ডেমোক্রিটাস এর নাম দেন অ্যাটম (Atom)। অ্যাটম শব্দের অর্থ অখণ্ডনীয়। অর্থাৎ যাকে আর ভাগ করা যায় না ।
এর প্রায় দুই হাজার বছর পরে বৃটেনের গণিত ও প্রকৃতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক জন ডালটন ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে এ পরমাণু বা অ্যাটমের নতুন ধারণা দেন। তিনি বলেন যে, প্রতিটি মৌলিক পদার্থ ঐ পদার্থের অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দ্বারা গঠিত । মৌলের এরূপ ক্ষুদ্রতম কণাকে বলা হয় সেই মৌলের পরমাণু বা অ্যাটম । অর্থাৎ মৌলিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা যা সংশ্লিষ্ট পদার্থের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে এবং যাকে আরও ভাগ করা হলে ঐ পদার্থের স্বাতন্ত্র্য সম্পূর্ণরূপে লোপ পায় তাকে পরমাণু (Atom) বলে।
পৃথিবীর সকল বস্তুই পরমাণু দ্বারা
গঠিত। পরমাণু খুবই সুক্ষ্ম। অতি শক্তিশালী অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যেও পরমাণু দেখা
যায় না। ২৫৪০ কোটি হাইড্রোজেন পরমাণুকে পাশাপাশি সাজালে মাত্র এক ইঞ্চি বা ২.৫৪ সেন্টিমিটার
এর মত লম্বা হয়। একশ আঠারোটি (১১৮) মৌলে ১১৮ রকম পরমাণু আছে। প্রত্যেক মৌলের পরমাণুর
নিজস্ব ওজন ও ধর্ম আছে। আবার একটি মৌলে যতগুলো পরমাণু আছে তাদের প্রত্যেকটি একই রকম।
হাইড্রোজেন শুধু হাইড্রোজেন পরমাণু দ্বারা, অক্সিজেন শুধু অক্সিজেন পরমাণু দ্বারা এবং
লোহা শুধু লোহার পরমাণু দ্বারা গঠিত। বিশেষ অবস্থায় পরমাণুকেও ভাগ করা সম্ভব। পরমাণুকে
ভাঙলে পারমানবিক শাক্তর উদ্ভব হয়। পরমাণু সম্পর্কে বিজ্ঞানী ডালটন যে মতবাদ দেন তা
ডালটনের পরমাণু তত্ত্ব নামে পরিচিত। এ তত্ত্বে তিনি বলেন :
(ক) মৌলিক পদার্থ অতি ক্ষুদ্র অখণ্ডনীয়
পরমাণু কণা দ্বারা গঠিত।
(খ) একই মৌলিক পদার্থের প্রতিটি পরমাণু
প্রকৃতিতে, ধর্মে ও ভরে একরকম। তাই হাইড্রোজেনের প্রতিটি পরমাণু ভরে ও ধর্মে একরকম।
তেমনি লোহার প্রতিটি পরমাণুও ভরে ও ধর্মে একই রকম।
(গ) ভিন্ন ভিন্ন মৌলের পরমাণু ধর্মে
ও ভরে একটি অন্যটি থেকে আলাদা। তাই হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন, সালফার, সোনা, রুপা,
লোহা ইত্যাদি মৌলের পরমাণু ধর্মে ও তরে পরস্পর হতে ভিন্ন। এ জন্য সোনার সাথে রুপার
বা হাইড্রোজেনের সাথে অক্সিজেনের ধর্ম ও তার কোনো মিল নেই।
(ঘ) বিভিন্ন মৌলের পরমাণু অখন্ড বা পূর্ণ সংখ্যার সরল অনুপাতে পরস্পর যুক্ত হয়ে যোগ গঠন করে ।
বিজ্ঞানী ডালটন প্রথম এ মতবাদ বা তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তাই এটি ডালটনের পরমাণু তত্ত্ব নামে পরিচিত।
অণু
বিজ্ঞানীদের মতে এ বিশ্বের সকল পদার্থই অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণু বা কণার সমষ্টি । কোনো পদার্থকে ভাগ করতে করতে যদি এমন সূক্ষ্ম কণায় পৌঁছানো যায়, তাকে আরও ভাগ করলে ঐ পদার্থের অস্তিত্ব নষ্ট হয়, স্বাধীন অস্তিত্ব আর থাকে না, এ অবস্থায় পদার্থের এ ক্ষুদ্রতম কণাকে অণু বলে ৷
যৌগ বা যৌগিক পদার্থের কণাগুলো কীভাবে
গঠিত বিজ্ঞানী ডালটনের পক্ষে তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি। হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ইত্যাদি
গ্যাসীয় মৌলগুলো প্রকৃতিতে স্বাধীনভাবে কী অবস্থায় থাকে সে সম্বন্ধে ডালটনের জীবিতকালেই
বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়। ১৮১১ সালে অ্যামেদেও অ্যাভোগ্যাড্রো নামে একজন
ইতালীয় বিজ্ঞানী বলেন যে, গ্যাসীয় মৌল হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ইত্যাদি প্রকৃতিতে স্বাধীন
পরমাণু রূপে থাকে না, থাকে দুটো পমাণুর যুক্ত কণা রূপে। তিনি এরূপ কণার নাম দেন মলিকুল
(Molecule) বা অণু। মলিকুল শব্দের অর্থ পুঞ্জ বা স্তুপ অর্থাৎ একাধিক
পরমাণুর জোট। অর্থাৎ অণু হল একাধিক পরমাণুর জোট। অ্যাভোগ্যাড্রোর মৃত্যুর প্রায় চল্লিশ
বছর পর তার এক ছাত্র ক্যানিজারো মলিকুল বা অণুর উক্ত ধারণাগুলোকে যথার্থ বলে প্রমাণ
করেন ।
অণু সম্পর্কে উপর্যুক্ত ধারণাগুলোকে নিম্নরূপভাবে প্রকাশ করা যায়-
মৌলিক বা যৌগিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম
কণা যা ঐ পদার্থের গুণাবলি বজায় রেখে স্বাধীনভাবে মুক্ত অবস্থায় থাকতে পারে তাকে
অণু বলে। সাধারণত অণুতে একাধিক পরমাণু থাকে। দুই বা ততোধিক পরমাণুর রাসায়নিক সংযোগে
অণু গঠিত হয় । অণু দুই প্রকার - মৌলিক অণু ও যৌগিক অণু ।
(১) মৌলিক বা মৌল অণু : একই মৌলের দুইটি বা তার বেশি পরমাণু একত্রে রক্ত হয়ে যে অণু গঠন করে তাকে মৌলিক বা মৌল অণু বলে ।
মৌলিক অণু |
(২) যৌগিক বা যৌগ অণু : ভিন্নরকম বা ভিন্নধর্মী মৌলের দুইটি বা তার বেশি পরমাণু একত্রে যুক্ত হয়ে যে অণু গঠন করে তাকে যৌগিক বা যৌগ অণু বলে।
যৌগিক অণু |
তবে পদার্থ মৌলিক হোক আর যৌগিক হোক
প্রত্যেক পদার্থের অণু নির্দিষ্ট সংখ্যক পরমাণু নিয়েই গঠিত । প্রায় সবগুলো মৌলিক
গ্যাস যেমন- হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ক্লোরিন প্রভৃতির অণুতেই দুইটি করে
পরমাণু থাকে। কিন্তু হিলিয়াম, নিয়ন ও আরগন গ্যাসের প্রতি অণুতেই শুধু একটি করে পরমাণু
আছে। আবার যৌগের অণু যেমন পানির অণু হাইড্রোজেনের দুইটি ও অক্সিজেনের একটি পরমাণু নিয়ে
গঠিত। অতএব তোমরা বুঝতে পেরেছ যৌগ বা যৌগিক পদার্থ দুই বা ততোধিক মৌলের রাসায়নিক সংযোগে
গঠিত হয়। যৌগিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণাকে ভাঙলে তা আর যৌগ থাকে না, যৌগ গঠনকারী মৌলিক
পদার্থগুলোর পরমাণুতে ভাগ হয়ে যায়। পানির অণুকে ভাঙলে তা আর পানি থাকে না, পানির
উপাদান হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পানি যৌগিক অণুর উদাহরণ। অক্সিজেন,
হাইড্রোজেন ইত্যাদির অণু মৌলিক অণু কিন্তু কার্বন ডাইঅক্সাইডের অণু যৌগিক অণু। অক্সিজেনের
অণু ভাঙলে শুধু অক্সিজেনের পরমাণু পাওয়া যায় কিন্তু কার্বন ডাইঅক্সাইডের অণু ভাঙলে
কার্বন ও অক্সিজেনের পরমাণু পাওয়া যায়।কার্বন ডাইঅক্সাইডের অণু কার্বনের একটি পরমাণু
অক্সিজেনের দুইটি পরমাণু নিয়ে গঠিত।
কয়েকটি যৌগিক অণু |
ছক : অণু ও পরমাণুর পার্থক্য
পরমাণু |
অণু |
১। পরমাণু মৌলিক পদার্থের
ক্ষুদ্রতম কণা । ২। সাধারণত পরমাণু স্বাধীনভাবে
মুক্ত অবস্থায় থাকতে পারে না, তবে কোনো কোনো মৌলিক পদার্থের পরমাণু স্বাধীনভাবে
থাকতে পারে। যেমন- হিলিয়াম, নিয়ন, আর্গন ইত্যাদি । ৩। পরমাণু সরাসরি রাসায়নিক
বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে । ৪। বিভিন্ন প্রকার পরমাণুর
সংখ্যা সীমিত। এ পর্যন্ত ১১৮ প্রকারের পরমাণু আবিষ্কৃত হয়েছে । ৫। পরমাণুকে ভাঙলে ঐ
মৌলের আর অস্তিত্ব থাকে না। |
১। অণু মৌলিক বা যৌগিক
পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা ২। অণু স্বাধীনভাবে
মুক্ত অবস্থায় থাকতে পারে। ৩। সাধারণত অণু সরাসরি
রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না। রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণের পূর্বে
অণু পরমাণুতে বিশ্লিষ্ট হয় ৪। পৃথিবীতে যৌগিক পদার্থের
সংখ্যা অসংখ্য বলে অণুর সংখ্যাও অসংখ্য । ৫। অণুকে ভাঙলে একই
বা ভিন্ন মৌলের পরমাণু পাওয়া যায়। |
কঠিন, তরল ও বায়বীয় পদার্থের গঠনে অণু ও পরমাণুর সমাবেশ
আমরা জানি যে আমাদের চারপাশে অগণিত
পদার্থ রয়েছে। ভৌত অবস্থা ভেদে পৃথিবীর যাবতীয় পদার্থকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।
যথা- কঠিন, তরল ও বায়বীয় ।
কঠিন পদার্থের অণু |
তরল পদার্থ : তরল অবস্থায় পদার্থের নির্দিষ্ট আয়তন থাকে। কিন্তু "নির্দিষ্ট আকার থাকে না। তরল পদার্থ যে পাত্রে রাখা যায় সেই পাত্রের আকার ধারণ করে ।
পরীক্ষা :
তরল পদার্থের নির্দিষ্ট আকার নেই |
তরল পদার্থের অণুর অবস্থান |
অতএব যে পদার্থের নির্দিষ্ট আয়তন থাকে কিন্তু নির্দিষ্ট আকার থাকে না, যখন যে পাত্রে রাখা যায় সেই পাত্রের আকার ধারণ করে তাকে তরল পদার্থ বলে। পানি, তেল, দুধ, পেট্রোল ইত্যাদি তরল পদার্থের উদাহরণ ।
কঠিন পদার্থের ন্যায় তরল পদার্থও অণুর জোট বা সমষ্টি নিয়ে গঠিত। কিন্তু এক্ষেত্রে কণাগুলো পরস্পরের সাথে শিথিলভাবে সংযুক্ত থাকে। অর্থাৎ তরল পদার্থের অণুগুলোর মধ্যে ফাঁক থাকে। তাই তরল পদার্থের মধ্যে একটা ঢলঢলে ভাব দেখা যায়। সে জন্য তরল পদার্থ যে পাত্রে রাখা যায় সেই পাত্রেরই আকার ধারণ করে । কিন্তু এর আয়তন একই থাকে ।
বায়বীয় পদার্থ : বায়বীয় পদার্থের কোনো নির্দিষ্ট আকার বা আয়তন নেই। মুক্ত
অবস্থায় রাখলে গ্যাস চারদিকে ছড়িয়ে যায়। বায়ু একটি গ্যাসীয় বা বায়বীয় পদার্থ
। তাই বায়ু পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে আছে ।
বায়বীয় পদার্থের অণুর অবস্থা |
যে পদার্থের নির্দিষ্ট আকার ও আয়তন নেই এবং যা মুক্ত অবস্থায় চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তাকে গ্যাসীয় বা বায়বীয় পদার্থ বলে ।
বায়বীয় পদার্থও অণুর সমন্বয়ে গঠিত।
কিন্তু এক্ষেত্রে অণুগুলো পরস্পর হতে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকে। অর্থাৎ বায়বীয় পদার্থের
মধ্যে অণুগুলো বেশ দূরে দূরে অবস্থান করে। ফলে অণুগুলোর মধ্যে আকর্ষণ শক্তি অতি সামান্য
বলেই অণুগুলো ছড়িয়ে পড়ে। সে জন্য গ্যাসীয় পদার্থ কোনো পাত্রে রেখে পাত্রের মুখ
বন্ধ করে দেয়া হয়। পাত্রের মুখ খুললে বা সামান্য ফাঁক থাকলে গ্যাস উড়ে যায় ।
ছক: কঠিন,
তরল ও বায়বীয় পদার্থের বৈশিষ্ট্য
কঠিন পদার্থ |
তরল পদার্থ |
বায়বীয়
পদার্থ |
কঠিন পদার্থের নির্দিষ্ট
আকার ও আয়তন থাকে। |
তরল পদার্থের নির্দিষ্ট আয়তন থাকে।
কিন্তু নির্দিষ্ট আকার থাকে না। |
বায়বীয় পদার্থের কোনো
নির্দিষ্ট আকার বা আয়তন থাকে না।
|
কঠিন পদার্থের অণুগুলো
পরস্পরের অত্যন্ত কাছাকাছি থাকে। অণুগুলোর মধ্যে কোনো ফাঁক থাকে না।
|
তরল পদার্থের অনুগুলো
পরস্পরের সাথে শিথিলভাবে সংযুক্ত থাকে এবং অণুর মধ্যে অপেক্ষাকৃত বেশি ফাঁক থাকে
। |
বায়বীয় পদার্থের অণুগুলো
পরস্পর দূরে দূরে অবস্থান করে। |
কঠিন পদার্থের অণুগুলোর
মধ্যে প্রবল আকর্ষণ থাকে । |
অণুগুলোর মধ্যে আকর্ষণ
কঠিন পদার্থের তলনায় কম থাকে। |
বায়বীয় পদার্থের অণুসমূহের
মধ্যে আকর্ষণ প্রায় নেই বললেই চলে। |
আন্ত-আণবিক দূরত্ব
কঠিন পদার্থের অনুর সমাবেশ |
আন্তঃআণবিক দূরত্ব আছে বলেই কাঠের মধ্যে পেরেক ঢুকানো যায়। এতে কাঠের অণুগুলো পরস্পরের আরও কাছে আসে। ফলে আন্তঃআণবিক দূরত্ব কমে যায়। এ কারণে পদার্থের আয়তন কমে যায়। আবার চাপ কমালে আন্তঃ আণবিক দূরত্ব বেড়ে যায় ফলে আয়তন বেড়ে যায়। অনুরূপভাবে পদার্থকে তাপ দিলে অণুগুলো গতিপ্রাপ্ত হয় এবং অণুগুলোর মধ্যে আন্তঃআণবিক দূরত্ব বেড়ে যায়। সে জন্য তাপ প্রয়োগ করলে পদার্থের আয়তন বাড়ে। আবার তাপ কমালে বা ঠান্ডা করলে আন্তঃআণবিক দূরত্ব কমে যাওয়ায় পদার্থের আয়তনও কমে ।
আন্তঃআণবিক শক্তি
পরীক্ষা-১ : একটি বিকারে সামান্য পরিমাণ কপার সালফেট এর গুঁড়া বা তুঁতে নাও এবং খুব সাবধানে বিকারটিতে পানি ভর্তি কর । এরপর বিকারটি নাড়াচাড়া না করে টেবিলের উপর রেখে দাও ।
পরীক্ষা-২ : একটি আতর বা সেন্টের শিশির মুখ খুলে টেবিলের উপর কিছুক্ষণ রেখে দাও ।
উপরের পরীক্ষা দুটোতে কী লক্ষ করছ।
বিকারে পানির কী পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে? বিকারের সব জায়গায় পানির রং কি একই রকম? ভালভাবে
লক্ষ করলে দেখতে পাবে বিকারে পানি কিছুটা নীল রং ধারণ করেছে এবং বিকারের তলায় যেখানে
তুঁতের গুঁড়া ছিল তার আশপাশে নীল রং অনেক বেশি।
দ্বিতীয় পরীক্ষাটিতে সেন্টের শিশির মুখ খোলার পর প্রথমে শিশির নিকটের শিক্ষার্থীরা গন্ধ পেয়েছিল এবং তারপর ক্রমান্বয়ে সমস্ত শ্রেণীকক্ষে সেন্টেন গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
আমরা জানি ভূতের গুড়া, আতর, সেন্ট সবই অণু দিয়ে গঠিত। সেন্টের অণু বাতাসে এবং তঁতের অণু পানিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। অণুগুলো স্থান পরিবর্তন করতে পারার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। পদার্থের অণুগুলোর পরস্পরের মধ্যে এক আকর্ষণ শক্তি কাজ করে। আর তাই অনুগুলো একে অন্যের কাছে থেকে দূরে সরে না গিয়ে এক জায়গায় জড়ো হয়ে থাকে। অণুগুলোর একের প্রতি অন্যের এ আকষণ শক্তিকে আন্তঃআণবিক শক্তি বলে। অন্যভাবে বলা যায়, পদার্থের অণুগুলোর মধ্যে এমন একটি আকর্ষণ শক্তি আছে যার ফলে অণুগুলো একে অন্যের সাথে পরস্পর নিবিড়ভাবে সংঘবদ্ধ থাকে। আবার অণুগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যাওয়ার একটি স্বাভাবিক বিকর্ষণ প্রবনতাও আছে । অণুগুলোর এ আকর্ষণ ও বিকর্ষণের মিলিত শক্তিকে আন্তঃআণবিক শক্তি বলে ।
কঠিন পদার্থের আন্তঃআণবিক শক্তি সবচেয়ে বেশি। এ জন্যই অণুগুলো পরস্পরের খুব কাছাকাছি অবস্থান করে এবং নড়াচড়া করলেও স্থানান্তারত হতে পারে না। নিজের জায়গা থেকেই অনবরত কাঁপতে থাকে। এ কারণে কঠিন পদার্থের নির্দিষ্ট আকার ও আয়তন থাকে। তরল পদার্থের আন্তঃআণবিক শক্তি কঠিন পদার্থের তলনায় কিছুটা কম সে জন্য অণুগুলো কিছুটা দূরে অবস্থান করে এবং স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে। এ কারনে তরল পাদার্থের নির্দিষ্ট আয়তন থাকলেও নির্দিষ্ট আকার নেই ।
বায়বীয় পদার্থের আন্তঃআণবিক শক্তি
সবচেয়ে কম। সে জন্যই অণুগুলো বেশ দূরে দূরে অবস্থান করে এবং কোনো আবদ্ধ পাত্রে না
রাখলে স্থানান্তরিত হয়ে চলে যেতে পারে। এ জন্যই গ্যাসীয় পদার্থের নির্দিষ্ট কোনে
আকার বা আয়তন নেই। সামান্য পরিমাণ গ্যাস একটি বড় পাত্রে রাখলে তা সমস্ত পাত্রে ছড়িয়ে
পড়ে পাত্রটিকে ভরে ফেলে। এ নগণ্য আন্তঃআণবিক শক্তির কারণেই সেন্টের শিশি থেকে সুগন্ধ
বহনকারী অণুগুলো প্রথমে শিশির নিকটের শিক্ষার্থীদের তারপর দূরের শিক্ষার্থীদের নাকে
পৌঁছে ছিল ।
তাপের প্রভাবে অণুর গতির পরিবর্তন এবং পদার্থের অবস্থান পরিবর্তন
আমরা জানি প্রকৃতিতে যে পদার্থগুলো কঠিন, তরল বা গ্যাসীয় অবস্থায় পাওয়া যায় তাপ বাড়িয়ে বা কমিয়ে সেই অবস্থার পরিবর্তন করা যায়। কঠিন বরফ একটু তাপেই গলে তরল পানিতে পরিণত হয়। তরল পানিকে তাপ দিলে গ্যাসীয় অবস্থায় জলীয় বাষ্পে পরিণত হয় । আবার জলীয় বাষ্পকে শীতল করলে তরল পানিতে এবং তরল পানিকে আরও শীতল করলে কঠিন বরফে পরিণত হয়। এভাবে তাপের পরিবর্তনের ফলে পদার্থের অবস্থার পরিবর্তন ঘটে।
স্বাভাবিক তাপমাত্রায় কঠিন পদার্থের অণুগুলো নিজের জায়গায় থেকেই অনবরত কাঁপতে থাকে। তাপ প্রয়োগ করলে অতিরিক্ত শক্তি লাভের ফলে অণুর কম্পন বেড়ে যায় ফলে অণুগুলো পরস্পর হতে একটু দূরে সরে যায়। আরও বেশি তাপ প্রয়োগ করলে পরস্পরের মধ্যকার দূরত্ব আরও বেড়ে যায়। ফলে আন্তঃআণবিক শক্তি কমে যায়। এতে অণুগুলো বেশ স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারে। এ অবস্থায় পদার্থ কঠিন থেকে তরলে রূপান্তরিত হয় । এর পরে আরও তাপ প্রয়োগ করলে অণুগুলো এত দ্রুতগতিতে চলাচল করে যে কিছু অণু আন্তঃআণবিক শক্তিকে পরাভূত করে তরল পদার্থের অন্যান্য অণুকে ছেড়ে উপরের দিকে উঠে যায়। এভাবে পদার্থ তরল থেকে গ্যাসীয় পদার্থে রূপান্তরিত হয় ।বিপরীতভাবে বায়বীয় পদার্থকে ঠান্ডা
করলে অণুর গতি কমে যায় এবং অণুগুলো পরস্পরের কিছুটা কাছে আসে। ফলে আন্তঃআণবিক শক্তি
বেড়ে যায় এবং আন্তঃআণবিক দূরত্বও কমে যায়। আরও ঠান্ডা করলে আন্তঃআণবিক শক্তি যথেষ্ট
বেড়ে গিয়ে গ্যাসীয় পদার্থ তরল পদার্থে রূপান্তরিত হয়। আবার তরল পদার্থকে ঠান্ডা
করলে অণুগুলো পরস্পরের আরও কাছাকাছি আসে এবং অণুগুলোর মধ্যকার দূরত্ব একেবারেই কমে
যায় । অণুগুলোর গতিও কমে যায়। অণুগুলো পরস্পরের কাছাকাছি আসে বলে আন্তঃআণবিক শক্তি
বেড়ে যায়। তরল পদার্থ অবশেষে কঠিন পদার্থে রূপান্তরিত হয়। এভাবে তাপের প্রভাবে পদার্থের
গতি ও পদার্থের অবস্থার পরিবর্তন ঘটে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন